আনন্দ মুখোপাধ্যায় :: ২৪ ঘন্টা লাইভ :: ১৯শে,মে :: কোলকাতা :: কোচবিহার ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত স্বাধীন রাজ্য ছিল। শাসক ছিলেন জগদীপেন্দ্র বাহাদুর। এ রকম এক রাজ্যের নাগরিক হিসেবে সেখানকার কোচ রাজবংশীরা এখন পশ্চিমবঙ্গে ‘শিডিউল কাস্ট’। আসাম ও বিহারে তারা ‘ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট’ এবং মেঘালয়ে ‘শিডিউল ট্রাইব’।
এদের সবার স্মৃতিতেই কমবেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে, এককালে তাদের পূর্বপুরুষদের ‘কামাতা’ নামে একটা স্বাধীন রাজ্য ছিল। সেসব স্মৃতি ও শ্রুতি থেকেই কামতাপুর আন্দোলনের জন্ম। দক্ষিণ এশিয়ার নানান সীমান্তে ছড়িয়ে থাকা কৃষিজীবী এই জনগোষ্ঠী আছেন বিহারের পূর্ণিয়ায়, বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের দিকেও।
কামতাপুর পিপলস পার্টির রাজনৈতিক সংগঠকেরা ছাড়াও কোচবিহারের সামন্তীয় ঐতিহ্যের শেষ প্রধান হিসেবে আছেন স্বঘোষিত এক ‘মহারাজা’ও। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ভয়ে এই মহারাজা অনন্ত রায় থাকেন আসামের চিরাংয়ে। রাজ্যহীন এই মহারাজা গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের একাংশের নেতা। বিজেপির অমিত শাহ নির্বাচনকালে আসাম গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। এই সাক্ষাৎ শেষে অনন্ত রায় বলছেন, ‘বৈঠক খুব ভালো হয়েছে।’ এর অর্থ, বিজেপি তাদের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল।
কোচ রাজবংশীদের ওই স্বঘোষিত মহারাজার দাবি, তারা জাতীয় পরিসরে বিজেপির নেতৃত্বে গঠিত জোটেও শরিক আছে। পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনকালে ইতিহাসের কোচ রাজা নারায়ণের নামে আধা সামরিক কোনো বাহিনীতে ‘নারায়ণী সেনা’ নামে একটা রেজিমেন্ট খোলারও অঙ্গীকার ছিল বিজেপির।
এসবই পশ্চিমবঙ্গের ভেতর বাংলাভাষী বনাম অন্যদের পরিচয়ের রাজনীতি, তথা বিচ্ছিন্নতার বোধ উসকে দিচ্ছে ক্রমে। এবারের নির্বাচনে কোচবিহারে প্রধান ইস্যু ছিল এসবই। তৃণমূলের পার্থ চট্টোপাধ্যায় একদা এমনও অভিযোগ তুলেছিলেন, (আউটলুক, ২ আগস্ট ২০১৬) বিএসএফ নারায়ণী সেনা নামে বেসরকারি একটা গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বিএসএফ তা অস্বীকার করে।
কোচ রাজবংশীদের হাতে রাখতে তৃণমূলও বসে নেই। তারা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ২০০ রাজবংশী স্কুলকে অনুমোদন দিয়েছে কিছুদিন হলো। রাজ্য পুলিশে তারাও নারায়ণী সেনা নামে একটা ব্যাটালিয়ন খুলবে বলেছে। মমতা বলেছেন, ওই ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর হবে কোচবিহারে। তৃণমূল একসময়কার হত্যা হামলার আসামি কামতাপুর আন্দোলনের নেতা বংশী বদনকেও কাছে টেনে নিয়েছে নানান হিসাব কষে, যেভাবে নিয়েছে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের বিমল গুরংকে।
কিন্তু এসব ব্যক্তিকে তৃণমূল নিজেদের দিকে টেনে আনলেও উত্তরের জমিতে বিচ্ছিন্নতার বীজে নানান তরফে জল ঢালা থেমে নেই। এর মধ্যে সর্বশেষ চমক দেখা গেল কেএলওর স্বঘোষিত চেয়ারম্যান জীবন সিং ৫ মে অজ্ঞাত স্থান থেকে সামরিক পোশাকে ১১ মিনিটের ভিডিও বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন উত্তরবঙ্গের মানুষের সামনে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট, কামতাপুর বা গ্রেটার কোচবিহার কিংবা উত্তরবঙ্গ নামে আলাদা এক প্রশাসনিক সত্তার ছবি ক্রমে শক্তি পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে। আর তাতে বিজেপি-আরএসএস পরিবারের সহানুভূতিরও নজির মিলছে।
উত্তরের জেলাগুলোয় নতুন রাজ্যের রাজনীতি ওদিকে আরএসএসের উত্থানের সঙ্গে মিলেমিশে এগোতে দেখা যায়। রাজ্যে আরএসএসের প্রায় ১ হাজার ৭০০ শাখার বড় অংশই রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোয়। ২০০৯ সালে লোকসভায় বামদের বিপর্যয়ের পর থেকে আরএসএস কোনো বিঘ্ন ছাড়াই একের পর এক শাখা বাড়াতে পারছে সেখানে। যার ফল পেল তারা এবার। উত্তরবঙ্গের অনেক নির্বাচনী এলাকাতেই নয়টি বুথ মিলে আরএসএসে একটা ‘শক্তিকেন্দ্র’ রয়েছে। ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মী এ রকম একেকটা শক্তিকেন্দ্রের কাজ তদারক করে। পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচটি ‘জোনে’ ভাগ করে ২০১৭ সাল থেকে আরএসএস যে কাজের ছকে আছে, তার প্রথম জোনই উত্তরবঙ্গ। অন্য চারে আছে তাদের ভাষায়, রাঢ়, নবদ্বীপ, হুগলি-মেদিনীপুর ও কলকাতা।
পশ্চিমবঙ্গ আয়তনে ছোট হয়ে যেতে পারে প্রায় ২২ হাজার
বর্গকিলোমিটার
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী ও তৃণমূলকে মোকাবিলার অঙ্ক মেলাতেই যে কেবল বিভিন্ন শক্তি কোচবিহার ও দার্জিলিং ঘিরে পৃথক রাজ্য বা
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে চায়, তা হয়তো নয়। উত্তরে যেকোনো নতুন রাজ্য গড়া কলকাতার বাঙালিদের বেশি পছন্দ নয়, সেটা বিজেপিসহ সবারই জানা। বিজেপি মনে করে, আশপাশের অঞ্চলকে ঘিরে চীনের যেভাবে গরম নিশ্বাস পড়েছে, তাতে কোচবিহার ও দার্জিলিংয়ে ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের আরও শক্তপোক্ত উপস্থিতি দরকার। এলাকাটি বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের কাছাকাছি। এ অঞ্চলেই রয়েছে ভারতের ভৌগোলিক নিরাপত্তার বড় গ্রন্থি ‘শিলিগুড়ি করিডর’। চীন চলে এসেছে কাছেই ভুটানের দোকলাম পর্যন্ত। বৃহত্তর রংপুরে প্রস্তাবিত তিস্তা পুনর্বাসন প্রকল্পে চীনের সংযুক্তিও ভাবাচ্ছে হয়তো ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের।
এসব বিবেচনায় ভারতীয় সামরিক-অসামরিক আমলাতন্ত্রের বিশেষ আগ্রহ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে। তাদের এ রকম ভাবনায় ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর প্রবল ছাপ আছে। কিন্তু স্থানীয় বাংলাভাষীদের কাছে সেটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতোই ব্যাপার। তবে বিজেপি যে গুছিয়ে এগোচ্ছে, তার প্রমাণ সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে পদ্মফুলের প্রার্থীরাই জেতেন কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংয়ে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনেও চার জায়গাতেই গেরুয়া শক্তি ভালো করল।
এই চার জেলা এবং সঙ্গে কালিম্পংসহ জলপাইগুড়ি অঞ্চলের পাঁচ জেলার ২৭ আসনে তৃণমূল মাত্র ৬টি পায়। বাকি ২১টি আসন গেছে বিজেপির ভান্ডারে। সব আসনে বিজেপির পক্ষে ভোটের ব্যবধানও ভালো। মমতার ‘জয় বাংলা’ ঢেউ যে এসব অঞ্চলে পরিচয়বাদী রাজনীতির উসকানি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিবেচনাতেই বলা হচ্ছে, এই নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে তৃণমূল জিতলেও পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অখণ্ডতার ঝুঁকিও জিতেছে বড় দাগে।
অন্তত দুটি নতুন রাজ্যের দাবি উৎসাহিত হচ্ছে সেখানে। ‘রাজ্য’-এর বদলে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ হলেও চলবে আগ্রহীদের। কিন্তু তাতে পশ্চিমবঙ্গ আয়তনে ছোট হয়ে যেতে পারে প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। মমতা আসন্ন এই ‘খেলা’ রুখবেন কীভাবে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় সবাই।