সুব্রত দাস :: ২৪ ঘন্টা লাইভ :: ২৫শে আগস্ট :: ভাটপাড়া :: ৩৫ বছর বয়সী নাসিমা বেগমের বাড়ি লুট হয় ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে। তাঁর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম থেকে সাইকেল, সিলিং ফ্যান, আসবাব নিয়ে যায় দাঙ্গাকারীরা। ঘটনার পরপরই কোভিডের কারণে কারখানার শ্রমিক নাসিমার স্বামীর রোজগারও বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে সম্পত্তি, অন্যদিকে জীবিকা—দুই–ই হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন নাসিমা ও তাঁর চার ছেলেমেয়ে।
এই লুটের ঘটনা যে শুধু নাসিমার বাড়িতেই ঘটেছিল, তা নয়। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে ব্যারাকপুর, জগদ্দল, কাকিনাড়া, ভাটপাড়া এবং নদীর পশ্চিম পাড়ে হুগলি, চন্দননগর প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে ২০১৭ থেকে ধারাবাহিক দাঙ্গায় অনেকেরই ঘরবাড়ি লুট হয়েছিল। মারাও গিয়েছিলেন অনেকে।
নাসিমা ও তাঁর প্রতিবেশীরা এখন সামান্য হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভাটপাড়ায় যে ‘পিস-সেন্টার’ বা শান্তি-আলয় চালু হবে বলে তাঁদের জানানো হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন কাজ শেখানো হবে। ‘মূলত সেলাই শেখানো হবে, যাতে আমরা কিছু রোজগার করতে পারি’—বললেন নাসিমা।
‘আমরা—এক সচেতন প্রয়াস’ নামের বিভিন্ন পেশার মানুষের একটি সংগঠন দাঁড়িয়েছে নাসিমার মতো ঘরবাড়ি লুট হয়ে যাওয়া মানুষের পাশে। গত কয়েক বছর ধরেই দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সমীক্ষা চালাচ্ছিল ‘আমরা’। শান্তি-আলয় তৈরি করেছে তারাই, সেন্টারটির উদ্বোধন হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার দিনে, ১৫ আগস্ট।
বিজয় রজক বলে যাঁর বাড়ির সামনের অংশে সেন্টারটি চালু করা হয়েছে, তিনি স্কুলের পোশাক বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘সেলাই কিছুটা শিখে গেলে কাজ পেতে সমস্যা হবে না। নারীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে শেখাতে হবে। আমাদের কাজ হবে তাঁদের জন্য কিছু কাজ খুঁজে আনা।’
মূলত পাটের ওপরে ভরসা করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলায় নদীর দুই ধার দিয়ে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ বণিকেরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় পাটসহ অবিভক্ত বাংলার বাণিজ্য নিয়ে ১৯৩৪ সালে ‘আ রিকভারি প্লান ফর বেঙ্গল’ নামের একটি বই লিখেছিলেন খুলনার শিল্প-ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র। তিনি লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গে যে পাট পরিশোধন করে সারা বিশ্বে পাঠানো হতো, তার প্রায় অর্ধেক আসত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ থেকে। পাট থেকে অবিভক্ত বাংলার বিরাট আয় হতো, তা তলানিতে ঠেকে দেশভাগের পরে।
ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিহার বা উত্তর প্রদেশের মতো জায়গা থেকে শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আনা শুরু হয়। তাঁদের সংস্কৃতি আলাদা হওয়ার কারণে শিল্পাঞ্চলে অশান্তি বাড়তে থাকে। উনিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গা এখন রাজনৈতিক দাঙ্গায় পরিণত, তার ফল ভুগতে হচ্ছে সব সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের। এই প্রথম একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে, শুধু দাঙ্গাপীড়িত নয়, অঞ্চলের সর্বস্তরের গরিব মানুষের পাশে স্থায়ীভাবে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে।
‘আমরা’র এক সদস্য শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী বললেন, ভাটপাড়ার পাশাপাশি হুগলি জেলার তেলেনিপাড়াতেও তাঁরা একটি সেন্টার চালানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘ভাটপাড়ায় আমরা মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলে তাঁদের জীবিকার ব্যবস্থার চেষ্টা করছি। আর নদীর ওপারে হুগলির তেলেনিপাড়ায় যেখানে খুব বড় দাঙ্গা হয়েছিল, সেখানকার মানুষ একটা দাবি করলেন, সেটাও মেটানোর চেষ্টা করছি।’
তেলেনিপাড়ার বাসিন্দারা জানান, ছোটরা পড়াশোনা করছে না। বড়রা যদি লেখাপড়া শিখতে শুরু করে, তবে ছোটরাও হয়তো উৎসাহিত হবে। তাই বয়স্কদের সন্ধ্যার দিকে পড়ানোর জন্য একটা সেন্টারও খোলা হয়েছে।
‘আমরা’র আরেক সদস্য দেবাশীষ পাল বললেন, ভাটপাড়ার প্রজেক্টে এখনো পর্যন্ত ২০ জন নারী স্থানীয় সমবায় ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছেন, আরও অনেকে আসছেন। দেবাশিস একজন মানবাধিকারকর্মীও বটে। তিনি জানালেন, নির্বাচনের পরে শিল্পাঞ্চলে দাঙ্গা থেমে গিয়েছে।